বায়ুমণ্ডলের উপাদান: বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন উপাদান ও স্তরবিন্যাস ভূগোল
→ উত্তর : বায়ুমণ্ডলের উপাদান—
বায়ুমণ্ডলের উপাদান: বায়ুমণ্ডল হল একটি যৌগিক মিশ্রণ। আবহুবিজ্ঞানীগণ বায়ুমণ্ডলের উপাদানগুলিকে প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। যেমন—(১) বিভিন্ন গ্যাসীয় পদার্থের মিশ্রণ, (২) জলীয় বাষ্প এবং (৩) বিভিন্ন জৈব ও অজৈব কণিকা।
(১) বিভিন্ন গ্যাসীয় পদার্থের মিশ্রণ—
(ক) নাইট্রোজেন—বায়ুমণ্ডলে নাইট্রোজেন সর্বাধিক পরিমাণে আছে (৭৮.১%)। (খ) অক্সিজেন—বায়ুমণ্ডলের দ্বিতীয় প্রধান
উপাদান হল অক্সিজেন (২০.৯%)। *.
(গ) কার্বন ডাই-অক্সাইড—বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ খুবই সামান্য (০.০৩৩%)।
(২) জলীয় বাষ্প—বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্প একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান । বায়ুমণ্ডলের আর্দ্রতা, মেঘ, বৃষ্টিপাত, তুষারপাত ইত্যাদি জলীয় বাষ্পের প্রভাবে সৃষ্টি হয় । বায়ুমণ্ডলের উন্নতা নিয়ন্ত্রণেও জলীয় বাষ্পের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তবে জলীয় বাষ্প বায়ুমণ্ডলের সব জায়গায় সমানভাবে থাকে না।
(৩) বিভিন্ন জৈব ও অজৈব কণিকা—গ্যাসীয় উপাদান ও জলীয় বাষ্প ছাড়াও বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন জৈব ও অজৈব কণিকা লক্ষ করা যায়। এগুলির মধ্যে শহরাঞ্চলে, শিল্পাঞ্চলে ধূলিকণা, মরু অঞ্চলে বালুকণা এবং সমুদ্রোপকূলবর্তী অঞ্চলে লবণকণা ইত্যাদি লক্ষ করা যায়। বায়ুমণ্ডলের স্তরবিন্যাস—
বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তরকে মূলত দুভাগে ভাগ করা যায়। যেমন— (ক) রাসায়নিক গঠন অনুসারে বায়ুমণ্ডলের স্তরবিন্যাস এবং (খ) উন্নতা অনুসারে বায়ুমণ্ডলের স্তরবিন্যাস।
(ক) রাসায়নিক গঠন অনুসারে বায়ুমণ্ডলের স্তরবিন্যাস—রাসায়নিক গঠন অনুসারে বায়ুমণ্ডলকে প্রধানত দুটি স্তরে ভাগ করা হয়
(১) হোমোস্ফিয়ার— সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ৯০ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বায়ুমণ্ডলের স্তরকে হোমোস্ফিয়ার বলে। হোমোস্ফিয়ার কথাটির অর্থ সমমণ্ডল। অর্থাৎ এই স্তরে বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের গঠন এবং এইসব উপাদানগুলির মধ্যে একটা সমানুপাতিক হার বজায় থাকে বলে এই স্তরকে সমমণ্ডল বা হোমোস্ফিয়ার বলে। হোমোস্ফিয়ার প্রধানত তিন
ধরনের উপাদান দ্বারা গঠিত। যথা—(১) বিভিন্ন গ্যাসীয় পদার্থের মিশ্রণ, (২) জলীয় বাষ্প, (৩) বিভিন্ন জৈব ও অজৈব কণিকা।
(২) হেটেরোস্ফিয়ার—হোমোস্ফিয়ারের ঊর্ধ্বে অর্থাৎ ৯০ কিমির ঊর্ধ্ব থেকে প্রায় ১০,০০০ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বায়ুমণ্ডলের স্তরকে হেটেরোস্ফিয়ার বলে। হেটেরোস্ফিয়ার কথাটির অর্থ • বিষমমণ্ডল। এই স্তরে বিভিন্ন গ্যাসীয় পদার্থের পরিমাণ এবং স্তরগুলি একই অনুপাতে থাকে না বলে এর এইরকম নামকরণ হয়েছে।
হেটেরোস্ফিয়ারের স্তরবিন্যাস—
হেটেরোস্ফিয়ারকে আবার চারটি উপস্তরে ভাগ করা যায়— (১) আণবিক নাইট্রোজেন স্তর, (২) পারমাণবিক অক্সিজেনের স্তর, (৩) হিলিয়াম স্তর এবং (৪) হাইড্রোজেন স্তর।
(খ) উন্নতা অনুসারে বায়ুমণ্ডলের স্তরবিন্যাস—উন্নতার তারতম্য অনুসারে বায়ুমণ্ডলকে কতকগুলি স্তরে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে সমমণ্ডল বা হোমোস্ফিয়ারে আছে ট্রপোস্ফিয়ার, স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার, ও মেসোস্ফিয়ার এবং বিষমমণ্ডল বা হেটেরোস্ফিয়ারে আছে আয়নোস্ফিয়ার, এক্সোস্ফিয়ার এবং ম্যাগনেটোস্ফিয়ার।
বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তর
(১) ট্রপোস্ফিয়ার—বায়ুমণ্ডলের সর্বনিম্ন স্তরটির নাম ট্রপোস্ফিয়ার। এটি ভূপৃষ্ঠ থেকে নিরক্ষীয় অঞ্চলে সর্বাধিক ১৮ কিমি এবং মেরু অঞ্চলে সর্বনিম্ন ৮ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত আছে। এছাড়া ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০০ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত বায়ুস্তর ভূপৃষ্ঠের আবহাওয়া ও জলবায়ুকে অনেকাংশে
প্রভাবিত করে। পৃথিবীর আবহাওয়ার যাবতীয় পরিবর্তন, অর্থাৎ মেঘ, ঝড়, ঝঞ্ঝা ইত্যাদি এই স্তরেই লক্ষ করা যায়। এই কারণে একে পরিবর্তনশীল স্তর বা ট্রপোস্ফিয়ার বলে। এই অংশ ক্ষুদ্ধমণ্ডল নামেও পরিচিত। পৃথিবীর আবহাওয়ার বেশিরভাগ প্রক্রিয়াই এই স্তরে সীমাবদ্ধ। এই স্তরে প্রতি ১ কিমি উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে উন্নতা ৬.৪° সে হারে কমে যায়। ট্রপোস্ফিয়ারের ঊর্ধ্বে ২–৩ কিমি বিস্তৃত স্তব্ধ স্তরটির নাম হল ট্রপোপজ।
(২) স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার—ট্রপোস্ফিয়ারের ঊর্ধ্বে প্রায় ৫০ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত স্তরটির নাম স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার। স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে মেঘ, ঝড়-ঝঞ্ঝা, ইত্যাদি থাকে না বলে জেট বিমানগুলি শান্ত আবহাওয়ার জন্য এই স্তর দিয়ে যাতায়াত করে। এই স্তরে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উন্নতা ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং প্রায় ৫০ কিমি উচ্চতায় বায়ুর তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি প্রায় ১০০ সে হয়। স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের ঊর্ধ্বে অবস্থিত স্তব্ধ স্তরটির স্ট্যাটোপজ নামে পরিচিত।
স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের মধ্যে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হল এই অংশে ওজোন গ্যাসের অবস্থান। এর ফলে শুধুমাত্র যে তাপমাত্রা বাড়ে তাই নয় সূর্য থেকে যে ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়, সেগুলি বায়ুমণ্ডলের এই অংশে ওজোন গ্যাসের স্তরটি থাকার জন্য ভূপৃষ্ঠে আর পৌঁছোতে পারে না।
(৩) মেসোস্ফিয়ার—স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের ঊর্ধ্বে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮০ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত স্তরটিকে মেসোস্ফিয়ার বলে। ৮০ কিমি উচ্চতায় বায়ুর তাপমাত্রা কমে –৯৩° সে হয়। মেসোস্ফিয়ারে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উন্নতা দ্রুত কমতে থাকে, ফলে এই স্তরের সর্বোচ্চ সীমায় উন্নতা হ্রাস পেয়ে প্রায় –১০০° সে-এর মতো হয়। বায়ুমণ্ডলের সর্বনিম্ন উন্নতা এই স্তরেই লক্ষ করা যায়। এই কারণে মহাকাশ থেকে পৃথিবীর দিকে আগত উল্কাপিণ্ড এই স্তরে এসে ছাই হয়ে যায়। মেসোস্ফিয়ারের ওপরের স্তব্ধ স্তরটির নাম হল মেসোপজ।
আয়নোস্ফিয়ার
(৪) আয়নোস্ফিয়ার—মেসোস্ফিয়ারের ঊর্ধ্বে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭০০ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বায়ুমণ্ডলের স্তরটিকে আয়নোস্ফিয়ার বলে। বায়ু এখানে খুব হালকা এবং প্রখর সূর্যরশ্মির জন্য ওই বায়ু আয়নিত হয়ে আছে। এই স্তরটি বেতার তরঙ্গের ক্ষেত্রে প্রতিফলকের মতো কাজ করে বলে পৃথিবীব্যাপী বেতার যোগাযোগ সম্ভব হয়েছে।
আয়নোস্ফিয়ারের নিম্নাংশ, অর্থাৎ প্রায় ৫০০ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত স্তরটিতে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উয়তা অতি দ্রুত হারে বাড়তে থাকে এবং প্রায় ৫০০ কিমি উচ্চতায় বায়ুমণ্ডলের সর্বাধিক উন্নতা (প্রায় ১২০০° সে) লক্ষ করা যায় । বায়ুমণ্ডলের সর্বাধিক উষ্ব এই স্তরটিকে থার্মোস্ফিয়ার বলে।
এই স্তরে তড়িদাহত অণুর চৌম্বক বিক্ষেপের ফলে মৃদু আলোযুক্ত এক জ্যোতি বা রশ্মির সৃষ্টি হয়। একে উত্তর মেরুতে সুমেরুপ্রভা এবং দক্ষিণ মেরুতে কুমেরুপ্রভা বলে। (৫) এক্সোস্ফিয়ার—আয়নোস্ফিয়ারের ঊর্ধ্বে বায়ুমণ্ডলে যে স্তরটি অবস্থিত তাকে এক্সোস্ফিয়ার বলে। এই স্তরে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম পরমাণুর ঘনত্ব লক্ষ করা যায়।
ম্যাগনেটোস্ফিয়ার
(৬) ম্যাগনেটোস্ফিয়ার-সাম্প্রতিককালে আবহবিদগণ এক্সোস্ফিয়ারের ঊর্ধ্বে ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের অস্তিত্বের কথা বলেছেন। কিন্তু এর সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত বিশেষ কিছু জানা যায়নি।