অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান কবিতার প্রশ্ন উত্তর বড় প্রশ্ন উত্তর Study Learn
অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান
জয় গোস্বামী
অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান কবিতা
অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান কবিতা: প্রশ্ন – ‘অস্ত্র ফ্যালো, অস্ত্র রাখো পায়ে’—কবি কেন অস্ত্র ফেলে দিতে বলেছেন? কবির এই আবেদনের মধ্যে তাঁর কোন্ মানসিকতা ধরা পড়েছে?
উত্তর : কবি জয় গোস্বামী তাঁর ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান’ কবিতায় অস্ত্রনির্ভর, ক্ষমতাদন্তী মানুষদের কাছে অস্ত্র ত্যাগের আবেদন রেখেছেন। অস্ত্র হিংসা, হানাহানি এবং ধ্বংসের প্রতীক। মানুষের নিকৃষ্টতম প্রবৃত্তিকে উৎসাহিত করে অস্ত্র। জাগিয়ে তোলে ক্ষমতার দন্ত।
বিচ্ছিন্নতার বীজ বপন করে মানুষের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর তুলে দেয়। শুভ চেতনা, সৌভ্রাতৃত্ব প্রভৃতি মানবিক গুণগুলিকে ধ্বংস করে মানুষকে পিশাচের পর্যায়ে নামিয়ে দেয়। হিংস্রতা বৃদ্ধি করে পৃথিবীর সংকটকে ঘনীভূত করে তোলে। এমন একটা নেতিবাচক উপাদানের জন্য অর্থব্যয়কে কবি অনর্থক বলে মনে করেন, তাই অস্ত্র ত্যাগের আবেদন রেখেছেন।
কবির এই আবেদনের মধ্যে যুদ্ধবিরোধী, মানবকল্যাণকামী মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে। পৃথিবীরক্রমবর্ধমান অস্ত্র প্রতিযোগিতায় কবি আতঙ্কিত। অস্ত্রনির্ভর স্বার্থান্ধ মানুষের পৈশাচিক তাণ্ডবের
পরিণতি কী হতে পারে তা তিনি উপলব্ধি করেছেন। তাই সভ্যতার শুভ চেতনা জাগ্রত করতে তিনি সচেষ্ট হয়েছেন। কবি দেখেছেন বিশ্বব্যাপী অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয় হয়ে যাচ্ছে বিরাট অঙ্কের অর্থ অথচ দেশের সাধারণ নাগরিকের নিরন্ন, কর্মহীন অবস্থা। সামান্য গ্রাসাচ্ছাদনের সংস্থানটুকু হচ্ছে না। এ এক ক্ষমাহীন অবিমৃষ্যকারিতা।
মানুষের শুভ চেতনা জাগ্রত করে তার সৃজনশীল সত্তাকে কবি উৎসাহিত করতে চান। তাই অস্ত্রের পরিবর্তে গানে তাঁর আস্থা। গান হলো প্রাণের ভাষা। গান শুভ চেতনা ও কল্যাণবোধকে জাগ্রত করে। মানবিক গুণগুলির বিকাশ ঘটায়। অস্ত্র গানের কণ্ঠরোধ করে, জীবনকে নারকীয় করে তোলে। কাজেই অস্ত্র ত্যাগের মধ্যেই আছে মানবের প্রকৃত কল্যাণ, আনন্দমুখর জীবনের সন্ধান।
প্রশ্ন – ‘তোমায় নিয়ে বেড়াবে গান/নদীতে, দেশগাঁয়ে’ —কার কোন্ কবিতার অংশ? প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বক্তব্যটির তাৎপর্য বুঝিয়ে দাও।
অথবা, ‘তোমায় নিয়ে বেড়াবে গান/নদীতে, দেশ-গাঁয়ে’ —এই মন্তব্যে গানের যে স্বভাব ধর্মের প্রকাশ ঘটেছে তা নিজের ভাষায় লেখো।
উত্তর : বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় কবি জয় গোস্বামীর ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান’ কবিতা থেকে উদ্ধৃতাংশটি উৎকলিত হয়েছে। ব্যক্তিজীবনে, জনজীবনে তথা সভ্যতায় গানের সীমাহীন অবদানের কথা বলতে গিয়ে কবির এই কাব্যিক উপস্থাপনা।
মানব-মনের ওপর গানের প্রভাব সুগভীর। গানের ঝরনাধারায় ধৌত হতে পারলে হৃদয়ের ক্ষত দূর হয়ে যায়। গানই পারে মানব-মনের গতিপ্রকৃতির ধারাকে বদলে দিতে। তাই তো অস্ত্রশক্তি বৃদ্ধির অশুভ প্রতিযোগিতায় বিশ্ব যখন উন্মাদ, অস্ত্রের আস্ফালন যখন মানুষের শুভ বোধবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে তখন কবি গানকেই অস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রধান অবলম্বন হিসেবে গণ্য করেছেন।
গানের শক্তি সীমাহীন। গানে আছে মানুষের শুভ চেতনা, সৃজনশীল সত্তাকে জাগ্রত করার ক্ষমতা। সত্য-শিব-সুন্দরের রক্ষায় মানুষের হৃদয়ের প্রতিবাদী সত্তাকে জাগ্রত করার ক্ষমতা। গানকে হাতিয়ার করেই একদিন শিখিপুচ্ছ ঋষিবালক বাঁশির সুরে মাতিয়েছিলেন মানুষকে। গানই পারে স্বার্থান্ধ জীবনের স্বার্থের দ্বন্দ্বে র জটিল চিত্তাজাল থেকে মানুষকে মুক্ত করতে।
মানুষের হৃদয়ের ভয়-ভুল-পাপের উৎসকে ধুয়ে মুছে নির্মল করতে। নদী-সৈকতে গ্রামবাংলার অবারিত সুন্দর প্রকৃতির আঁচলতলে ভ্রমণের অনাবিল আনন্দে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে। সুতরাং জীবনকে পরিপূর্ণ সৌন্দর্যে উপভোগ করার প্রয়োজনে গানের দরিয়ায় ভাসতে হবে প্রাণের আনন্দে। এক্ষেত্রে কবির পরামর্শ—‘অস্ত্র ফ্যালো, অস্ত্র রাখো গানের দুটি পায়ে …..’।
প্রশ্ন-. ‘গান দাঁড়াল ঋষিবালক / মাথায় গোঁজা ময়ূরপালক’— গানকে ঋষিবালকের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে কেন? ঋষিবালক রূপে গান কোন্ ভূমিকা পালন করবে?
উত্তর : কবি জয় গোস্বামীর ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান’ কবিতা থেকে উদ্ধৃতাংশটি উৎকলিত হয়েছে। অস্ত্রবিরোধী এই কবিতায় কবি অস্ত্রের আস্ফালনের বিরুদ্ধে গানের বলিষ্ঠ ভূমিকাকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। গানকে শিখিপুচ্ছ ঋষিবালকের সঙ্গে তুলনা করে চমৎকার কাব্যোৎকর্ষতার পরিচয় দিয়েছেন কবি।
ঋষিবালকটিকে যদি শ্রীকৃষ্ণরূপে কল্পনা করা যায় তাহলে তাঁর কংসবধের অধ্যায়টিকে অস্ত্রের অশুভ আস্ফালনের বিরুদ্ধে গানের সাফল্য হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। বংশীধারী শ্রীকৃষ্ণ অসির বদলে বাঁশিকেই হাতে তুলে নিয়ে কংসের অত্যাচারে হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে এসেছিলেন। অস্ত্রের বিরুদ্ধে গানের ভূমিকাও দৃঢ় কিন্তু মাধুর্যপূর্ণ।
হিংসায় উন্মত্ত অস্ত্রনির্ভর পৃথিবীতে গান ঋষিবালক রূপে বিরাট ভূমিকা পালন করবে। অস্ত্রের অশুভ বিস্তার মানব প্রবৃত্তির নীচতাকে বৃদ্ধি করে চলেছে। হিংসা, হানাহানি, রক্তপাতে জীবন নারকীয়, বীভৎস হয়ে উঠেছে। সমাজটা যেন ভাগাড় হয়ে উঠেছে। মাথার ওপর চক্কর কাটছে চিল-শকুনের দল। এই অবস্থায় শক্তি ও মাধুর্যের প্রতীক ঋষিবালকের আবির্ভাব এক বিরাট ভরসা।
ঋষিবালকের অমৃতময় বংশীধ্বনির মতো গান নির্মল ঝরনাধারায় স্নাত করবে মানুষকে। হিংসাকুটিল স্বার্থান্ধ মনোবৃত্তি ঘুচিয়ে জাগাবে শুভ চেতনা। সৃষ্টিশীল করবে হৃদয়কে। এভাবে অস্ত্রনির্ভর যুদ্ধক্লান্ত মানুষ প্রেম-মানবতায় পূর্ণ সহজ সরল, পবিত্র, অনাবিল এক জীবন স্রোতে শামিল হবে। কবির কথায়—‘তোমায় নিয়ে বেড়াবে গান / নদীতে, দেশগাঁয়ে।’
প্রশ্ন – কবি জয় গোস্বামীর ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান’ কবিতায় যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের যে প্রকাশ ঘটেছে তা নিজের ভাষায় বিবৃত করো।
উত্তর :বিবেকী কবি জয় গোস্বামী ‘পাতার পোষাক’ কাব্যগ্রন্থের ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান’ কবিতায় গানের নান্দনিক সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের ভয়াবহতাকে অতিক্রম করতে চেয়েছেন।
{ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অস্ত্রের আস্ফালনের সাহায্যে সভ্যতার গতিপ্রকৃতিকে স্তব্ধ করতে চায়। অন্যদিকে সৃষ্টির সম্ভাবনাকে বুকে নিয়ে গান মানুষের পৃথিবীতে সম্প্রীতি ও ভালোবাসার ছবি আঁকতে ) চায়। হৃদয়তন্ত্রীতে জন্ম নেওয়া গান অনন্ত শান্তির কথা বলে।
অস্ত্রের ব্যবহার মানুষের কোমল প্রবৃত্তির অপমৃত্যু ঘটায়, তার হননশীল মনোভাবকে জাগ্রত করে। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘জ্বলন্ত জিরাফ’ কবিতায় তীক্ষ্ণ বিদ্রূপে তাই লেখেন—
পুলিশ এসে বলেছিলো, এই নিয়ে সাতটা খুনের জন্য তুমি মোট তেরোটা ছুরি ভেঙেছো। ইস্পাতের এ-রকম অনটনের দিনে তোমার অমন বিলাসিত।” অন্যদিকে, গান মানুষের অন্তর প্রকৃতিকে নিষ্পাপ করে, কলুষ মুক্ত করে। জয় তাই গানের পবিত্রতার কথা বলতে গিয়ে লেখেন
“গান দাঁড়াল ঋষিবালক/মাথায় গোঁজা ময়ূর পালক।”
কবি হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীর পরিবর্তে এক শান্ত, সমাহিত, সুচেতনার পৃথিবী চান যেখানে রণ-রক্ত-সফলতা কখনোই শেষ সত্য হবে না। প্রকৃতির অমলিন পটভূমিতে গান তখন হবে মানবতার শ্রেষ্ঠ আশ্রয়।
প্রশ্ন – “অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান” কবিতার মূল বক্তব্য নিজের ভাষায় লেখো। (মাধ্যমিক, ২০১৯)
উত্তর : কবি জয় গোস্বামী বাংলা সাহিত্যে বিশ-একুশ শতকের এক বিশিষ্ট কবি। তাঁর লেখা ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান’একটি কালজয়ী কবিতা। কবি অস্ত্রবাজ যুদ্ধবাজদের অস্ত্রকে পায়ে ফেলে রাখতে বলছেন। তিনি গানের বর্ম গায়ে পরেছেন। সকল আহত মানুষের প্রতীক হয়ে হাজার হাতে পায়ে এগিয়ে আসেন, উঠে দাঁড়ান, হাত নাড়িয়ে বুলেট তাড়ান। গানের সম্বল সামান্যই। কবি গানের স্পর্শে অস্ত্রাঘাতের রক্ত মোছেন।
নিহত মানুষের শবের লোভে শকুন-চিলের মতো স্বার্থলোভী অস্ত্রধারীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কবির আছে নানা উপায়ে বাঁধা গানের কোকিল। কবি অস্ত্রধারীদের গা থেকে বর্ম খুলে খালি গা হয়ে দেখতে বলছেন। তখন সে দেখবে নিরস্ত্র গান খালি-গা ঋষিবালক হয়েছে—তার মাথায় ময়ূরপালকের দৃষ্টিলোভন মধুর সৌন্দর্য। তখন অস্ত্র ফেলে দেওয়াদের নিয়ে গান নদীতে, দেশগাঁয়ে প্রসন্ন নিরুবেগে বেড়িয়ে বেড়াবে। নামবে শান্তি। অতএব গানের কাছে অস্ত্র সমর্পিত হোক।
প্রশ্ন – ‘অস্ত্র রাখো গানের দুটি পায়ে….’—অস্ত্র কীসের প্রতীক? কবি অস্ত্রধারীদের উদ্দেশে যে পরামর্শ দিয়েছেন তা নিজের ভাষায় লেখো।
উত্তর : অস্ত্র হিংসা, হানাহানি, রক্তপাত, অশুভ শক্তির আসুরিক আস্ফালনের প্রতীক। নিদারুণ নৃশংসতা, সীমাহীন ধ্বংস অস্ত্রের প্রকৃতিতে নিহিত।
কবি মানবতাবাদী। মানুষকে হিংস্রতা, হানাহানি, রক্তপাতের নারকীয় দুঃস্বপ্নের জীবন থেকে শুভ চেতনায়, মঙ্গলবোধে উদ্বুদ্ধ এক আনন্দময় জীবনে ফেরানো তাঁর মূল অভিপ্রায়। তাই অস্ত্রধারীদের উদ্দেশে তাঁর আবেদন—‘অস্ত্র ফ্যালো, অস্ত্র রাখো পায়ে’ অর্থাৎ, সরল কথায় অস্ত্র ত্যাগ করো, অস্ত্রকে অবহেলা করো। অস্ত্র মানব প্রকৃতির নিকৃষ্টতম চরিত্রকে উৎসাহিত করে।
মানুষে মানুষে ভেদাভেদের প্রাচীর তুলে দেয়। জীবনকে কদর্য, গ্লানিময় এবং অনিশ্চিত করে তোলে। কাজেই অস্ত্র নয়, গানের বর্ম গায়ে পরে গানকেই করতে হবে হাতিয়ার। গানের গায়ে রক্ত মুছে শুচিস্নাত, পবিত্র হতে হবে। অর্থাৎ গানে যে প্রাণের ভাষা, প্রেমের বার্তা, সৃজনশীলতার ইঙ্গিত আছে তা উপলব্ধি করতে হবে। কবি আরও বলেছেন, ‘বর্ম খুলে দ্যাখো আদুড় গায়ে’ অর্থাৎ, হিংসা, হানাহানি,
অস্ত্রের আস্ফালন যে আমানবিক বর্মে আচ্ছাদিত করেছে, সে বর্ম খুলে ফেলে শুদ্ধ, নির্মল আত্মাকে প্রত্যক্ষ করো। তাহলেই গানের অর্থাৎ, প্রেমের ভাষার মর্মোদ্ধার করা যাবে। গান যেন শিখিপুচ্ছ ঋষিবালক। সহজ সরল জীবনকে সহজ আনন্দে মাতিয়ে দেয় সে। জীবনকে দান করে নবতর তাৎপর্য। তাই কবির { পরামর্শ অস্ত্র ফেলে দাও। অস্ত্র সমর্পণ করো গানের পায়ে। অর্থাৎ গানকেই করো জীবনের ধ্রুবতারা।
প্রশ্ন – গান কীভাবে অস্ত্রের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে তা ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান’ কবিতা অনুসারে লেখো।
উত্তর : কবি জয় গোস্বামী তাঁর ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান’ কবিতায় অস্ত্রের অপরিসীম ধ্বংসক্ষমতার বিরুদ্ধে গানকেই হাতিয়ার করেছেন। প্রমাণ করেছেন গান অস্ত্রের চেয়ে বেশি শক্তিশালী।
অস্ত্র এবং গান চরিত্রগতভাবে পরস্পর বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। অস্ত্র হত্যা করে, আতংক সৃষ্টি করে ধ্বংস করে। গান প্রাণে সুধা সঞ্চার করে। প্রেমের মন্ত্রে দীক্ষিত করে। সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করে। কবি দেখেছেন অস্ত্র হাতে নিয়ে মানুষ হিংস্রতার মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে। হানাহানি, রক্তপাত, ধ্বংসযজ্ঞ চলছে নির্বিচারে।
।এই অবস্থায় হাত গুটিয়ে বসে থাকা শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। অস্ত্রের এই আস্ফালন, অস্ত্রধারীদের এই ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করা প্রয়োজন। কবি জানেন অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে অস্ত্রের আস্ফালন কমানো যাবে না। অমানবিকতার বিরুদ্ধে অমানবিকতা কোনো অস্ত্র নয়। আগুন দিয়ে আগুন নেভানো যায় না। প্রয়োজন শুভ বোধবুদ্ধির বিকাশ, প্রকৃত কল্যাণকর প্রয়াস।
গানের ক্ষমতা অপরিসীম, গান প্রাণে সুধা সঞ্চার করে হৃদয়ের যাবতীয় দীনতা-দুর্বলতা, পাপকে ধুয়ে মুছে নির্মল করে। শুভ চেতনা, সৃজনশীলতা জাগ্রত করে। ঐক্যবদ্ধ করে বিচ্ছিন্ন মানুষদের। গানের বর্ম গায়ে পরে নিয়েই কবি অস্ত্রের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়িয়েছেন— ‘আমি এখন হাজার হাতে পায়ে / এগিয়ে আসি, উঠে দাঁড়াই / হাত নাড়িয়ে বুলেট তাড়াই’। বুলেট যেন মশা-মাছি।
অস্ত্র যে রক্তক্ষরণ ঘটায়, যে ক্ষত সৃষ্টি করে, গান তাতে দেয় স্নিগ্ধ উপসমকারী মলমের প্রলেপ। গান খুব বেশি নয়, একটা, দুটো কিন্তু তার শক্তি অনেক। একটিমাত্র কোকিল সহস্র উপায়ে গান বেঁধে শকুন বা চিলের হিংস্রতাকে ভুলিয়ে দিতে পারে। গানই পারে হৃদয়কে ধৌত করে অনাবিল, সরল-সুন্দর জীবনের ধারায় বইয়ে দিতে। তাই গান অস্ত্রের চেয়ে বেশি শক্তিধর সর্বযুগে, সর্বকালে।
প্রশ্ন – ‘অস্ত্র ফ্যালো, অস্ত্র রাখো পায়ে’—কবি কেন অস্ত্র ফেলে দিতে বলেছেন? কবির এই আবেদনের মধ্যে তাঁর কোন্ মানসিকতা ধরা পড়েছে?
উত্তর : কবি জয় গোস্বামী তাঁর ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান’ কবিতায় অস্ত্রনির্ভর, ক্ষমতাদত্তী মানুষদের কাছে অস্ত্র ত্যাগের আবেদন রেখেছেন। অস্ত্র হিংসা, হানাহানি এবং ধ্বংসের প্রতীক। মানুষের নিকৃষ্টতম প্রবৃত্তিকে উৎসাহিত করে অস্ত্র। জাগিয়ে তোলে ক্ষমতার দত্ত। বিচ্ছিন্নতার বীজ বপন করে মানুষের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর তুলে দেয়।
।শুভ চেতনা, সৌভ্রাতৃত্ব প্রভৃতি মানবিক গুণগুলিকে ধ্বংস করে মানুষকে পিশাচের পর্যায়ে নামিয়ে দেয়। হিংস্রতা বৃদ্ধি করে পৃথিবীর সংকটকে ঘনীভূত করে তোলে। এমন একটা নেতিবাচক উপাদানের জন্য অর্থব্যয়কে কবি অনর্থক বলে মনে করেন, তাই অস্ত্র ত্যাগের আবেদন রেখেছেন।
কবির এই আবেদনের মধ্যে যুদ্ধবিরোধী, মানবকল্যাণকামী মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে। পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান অস্ত্র প্রতিযোগিতায় কবি আতঙ্কিত। অস্ত্রনির্ভর স্বার্থান্ধ মানুষের পৈশাচিক তাণ্ডবের
পরিণতি কী হতে পারে তা তিনি উপলব্ধি
করেছেন। তাই সভ্যতার শুভ চেতনা জাগ্রত করতে তিনি সচেষ্ট হয়েছেন। কবি দেখেছেন বিশ্বব্যাপী অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয় হয়ে যাচ্ছে বিরাট অঙ্কের অর্থ অথচ দেশের সাধারণ নাগরিকের নিরন্ন, কর্মহীন অবস্থা। সামান্য গ্রাসাচ্ছাদনের সংস্থানটুকু হচ্ছে না। এ এক ক্ষমাহীন অবিমৃষ্যকারিতা।
মানুষের শুভ চেতনা জাগ্রত করে তার সৃজনশীল সত্তাকে কবি উৎসাহিত করতে চান। তাই অস্ত্রের পরিবর্তে গানে তাঁর আস্থা। গান হলো প্রাণের ভাষা। গান শুভ চেতনা ও কল্যাণবোধকে জাগ্রত করে। মানবিক গুণগুলির বিকাশ ঘটায়। অস্ত্র গানের কণ্ঠরোধ করে, জীবনকে নারকীয় করে তোলে। কাজেই অস্ত্র ত্যাগের মধ্যেই আছে মানবের প্রকৃত কল্যাণ,আনন্দমুখর জীবনের সন্ধান।
প্রশ্নঃ ‘অস্ত্র রাখো, অস্ত্র ফ্যালো পায়ে’—কাদের উদ্দেশ্যে কবির এই আবেদন? এই আবেদনের কারণ কী?
উত্তর : কবি জয় গোস্বামী ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান’ কবিতায় ক্রমশ হিংসাশ্রয়ী হয়ে ওঠা আধুনিক সভ্যতায় অস্ত্রধারী, যুদ্ধবাজ মানুষদের উদ্দেশে এই আবেদন রেখেছেন। অস্ত্র হিংসা, হানাহানি, রক্তপাত, পৈশাচিকতাকে উৎসাহিত করে। মানুষের নীচ প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে জীবনকে কদর্য ও গ্লানিময় করে তোলে।
হিংসার হুতাশনে আহুতি দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক্ করে দেয় জীবনের আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যকে। অস্ত্র বাড়িয়ে তোলে হিংসা, বিদ্বেষ ও ক্ষমতার দম্ভ অস্ত্রের আস্ফালনে আধুনিক জীবন বিপন্ন। প্রায় রণক্ষেত্র হয়ে উঠেছে আধুনিক সভ্যতা। এভাবে অস্ত্রের আস্ফালন বেড়ে চললে শুধু মানবতা বিপন্ন হবে তাই নয়, সভ্যতাও ধ্বংস হয়ে যাবে।
মানবতাবাদী কবি মানুষের অস্ত্রনির্ভরতা, অস্ত্রের আস্ফালন দেখে আতঙ্কিত। অস্ত্র কত ভয়ানক রূপ নিয়ে, কতটা বিধ্বংসী চরিত্র নিয়ে দেখা দিতে পারে ইতিহাসে তার প্রমাণ যথেষ্ট অস্ত্র হাতে নিয়ে অস্ত্রের আস্ফালন প্রতিরোধ করা যায় না। আগুন দিয়ে নেভানো যায় না আগুন। অস্ত্রের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো প্রতিরোধ হলো ঐক্যবদ্ধ মানুষের নির্ভীক-নিরস্ত্র শাস্তি পূর্ণ প্রতিবাদ।
সবচেয়ে বড়ো দেয়ালটি হলো শুভবোধের জাগরণ, মানবিক, প্রেমপ্রীতি এবং ঐক্যবদ্ধ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। তাই অস্ত্র ত্যাগের আবেদন রেখেছেন কবি হিংসাশ্রয়ী, অস্ত্রনির্ভর মানুষের কাছে। গানকে আশ্রয় করে প্রাণকে শুচিস্নাত করতে বলেছেন। মানব সভ্যতার সার্বিক কল্যাণ এবং অগ্রগতি হিংসা, হানাহানিতে নেই, আছে ঐক্যবদ্ধ মানবতার নব নব বিকাশে।
প্রশ্ন – ‘আমার শুধু একটা কোকিল/গান বাঁধবে সহস্র উপায়ে’— ‘শুধু একটা কোকিল’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? গান বাঁধার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : জয় গোস্বামীর ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান’ কবিতায় ‘শুধু একটা কোকিল’ কথাটি যথেষ্ট তাৎপর্যবহ। কোকিল বলতে কবি এখানে মানবকল্যাণ বোধ, শুভ চেতনা এবং শাশ্বত সৃষ্টিশীল সত্তাকে বুঝিয়েছেন। সমকালীন সভ্যতায় হিংসাশ্রয়ী মানুষ অস্ত্রশক্তিতে আস্থাশীল হয়ে নির্লজ্জ মারণযজ্ঞ শুরু করেছে। একটা সামগ্রিক ধ্বংসের পটভূমি রচিত হয়েছে। চিল-শকুনের মতো
লোভী, হিংস্ৰ, স্বার্থান্থ শ্রেণি সমাজ নামক ভাগাড়টির ওপর চক্কর কাটছে। এই অবস্থাতেও কবি সীমিতসংখ্যক শুভ বোধবুদ্ধিসম্পন্ন সৃষ্টিশীল সত্তার ওপর আস্থা রেখেছেন।
স্বার্থান্ধ হিংসাশ্রয়ী অস্ত্রনির্ভর ধূর্ত দানবের মত্ততায় পৃথিবী ধ্বংসের মুখোমুখি প্রায়। বেড়ে চলেছে অস্ত্রশক্তির আস্ফালন। বুলেটে বেয়নেটে মানুষকে ছিন্নভিন্ন করে বীভৎস বন্যজীবন রচনার প্রয়াস চলছে। এই অবস্থায় মানবতাবাদী কবি গানের ঝরনাধারায় ধুয়ে দিতে চান হিংস্র মানবের হৃদয়ের আদিমতম পাপকে।
গানে আছে প্রাণের সুধা। জীবনের যাবতীয় জ্বালা-যন্ত্রণা ভুলিয়ে প্রেম-মমতার এক মায়াময় প্রলেপ দিতে পারে গান। অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিংসাকে বাড়িয়ে চলে। রচিত হয় ধ্বংসের পটভূমি। তাই অস্ত্রের বিরুদ্ধে কবির একমাত্র হাতিয়ারটি হলো গান।
তিনি গানের বর্ম গায়ে পরে নিয়ে নির্ভয়ে দাঁড়িয়েছেন বুলেটের সামনে। গানের শক্তিতে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলে বন্ধ করবেন অস্ত্রের আস্ফালন। গান সহস্ৰ উপায়ে হৃদয়ের ক্ষত মুছে দিয়ে মানুষকে স্মরণ করাবে তার অমৃতময় সত্তার কথা।
প্রশ্ন – ‘হাত নাড়িয়ে বুলেট তাড়াই/গানের বর্ম আজ পরেছি গায়ে’—‘হাত নাড়িয়ে বুলেট তাড়াই’ কথাটির অর্থ কী? ‘গানের বর্ম আজ পরেছি গায়ে’ কথাটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
উত্তর : জয় গোস্বামীর ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান’ কবিতা থেকে উদ্ধৃতাংশটি উৎকলিত হয়েছে। বুলেট পেশিশক্তি তথা পশুশক্তির প্রতীক। অস্ত্রনির্ভর স্বার্থান্ধ মানুষ নিজের স্বার্থরক্ষা এবং শক্তি কায়েম করতে বুলেট বর্ষণ করে আতংক সৃষ্টি করে থাকেন। স্বার্থের দ্বন্দ্বে বাড়ে অস্ত্রের আস্ফালন, পদদলিত হয় প্রেম, অনুভব, মানবতা।
এই সংকটকালীন অবস্থায় কবি প্রতিবাদ জানান মানবিক কায়দায়। গান তাঁর প্রতিবাদের ভাষা। গানের মাধ্যমে শুভ বুদ্ধি, শুভ চেতনার বিকাশ ঘটিয়ে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে বলিষ্ঠ প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন অস্ত্রনির্ভর আস্ফালনের বিরুদ্ধে। মানুষের সমষ্টিগত শুভ চেতনার জাগরণের সামনে বুলেট মশা-মাছির তুচ্ছ হয়ে যাবে।
ক্রমবর্ধমান অস্ত্রশক্তির আস্ফালনের মুখে কবি গানের বর্ম গায়ে পরে হাজার হাতে পায়ে এগিয়ে আসেন, উঠে দাঁড়ান ৷ অর্থাৎ গানের নিহিত শক্তিতে শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। গানের ক্ষমতা সীমাহীন। গানেই আছে প্রাণের ভাষা, প্রেমের ভাষা, সৃজনশীলতার প্রেরণা। আবার গানেই আছে প্রতিবাদের ভাষা।
বুলেটে-বারুদে ক্ষতবিক্ষত আত্মাকে প্রেমের সুধায় বলিষ্ঠ করে তোলে গান। ভারতের জাতীয় আন্দোলন তথা বিশ্বের গণমুক্তি আন্দোলনেও গানের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তাই অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রকে কবি হাতিয়ার করেননি। গানের সুধা বর্ষণের মাধ্যমে প্রাণের বিকাশসাধনে, মানবতাবোধের বিকাশে সচেষ্ট হয়েছেন। গানকেই করেছেন তিনি অঙ্গভূষণ। অস্ত্রশক্তির আতঙ্কের মুখে গানই একমাত্র ভরসা। একমাত্র রক্ষাকবচ।