নেপোলিয়নের-পতনের-কারণ-গুলি আলোচনা-কর-Study-Learn
History

নেপোলিয়নের পতনের কারণ গুলি আলোচনা কর Study Learn

নেপোলিয়নের পতনের কারণ গুলি আলোচনা কর Study Learn

প্রশ্ন । নেপোলিয়নের পতনের কারণ গুলি কি কি?

নেপোলিয়নের পতনের জন্য গ্রেটব্রিটেন কতদূর দায়ী ছিল?

অথবা,

নেপোলিয়নের পতনে স্পেন এবং রাশিয়ার অবদানের মূল্যায়ন কর।

নেপোলিয়নের পতনের কারণ:

উত্তর।

নেপোলিয়নের পতনের কারণ: অসামান্য প্রতিভাসম্পন্ন সমর নায়ক নেপোলিয়নের পতন আপাতদৃষ্টিতে অভাবনীয় বলিয়া মনে হইলেও তাহা আকস্মিক ব্যাপার ছিল না। ১৮০৮খ্রীষ্টাব্দেরপর নেপোলিয়নের জীবনে পতনের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং অবশেষে ১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি চূড়ান্ত পরাজয়ের সম্মুখীন হন। কিন্তু নেপোলিয়নের পতন কোন বিশেষ কারণের ফলশ্রুতি ছিল না। বহুবিধ কারণে তাঁহার পতন অনিবার্য হইয়া উঠে।

নেপোলিয়নের-পতনের-কারণ-গুলি আলোচনা-কর-Study-Learn

নেপোলিয়নের অনমনীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষা

নেপোলিয়নের অনমনীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষার মধ্যেই তাঁহার পতনের কারণ নিহিত ছিল তিনি অনন্যসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ও পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমরনায়ক ছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু সমগ্র ফ্রান্সের একচ্ছত্র অধিপতি হইয়া তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না তাঁহার আকাঙ্ক্ষা ছিল, তিনি সমগ্র ইওরোপের ভাগ্যবিধাতারূপে এক বিরাট সাম্রাজ্য গড়িয়া তুলিবেন ।

তাঁহার উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবতার সীমা ছাড়াইয়া গিয়াছিল। তিনি ভাবিতেন, পৃথিবীতে এমন কিছু নাই, যাহা তিনি অধিকার করিতে পারিবেন না। কিন্তু যত বড় দিগ্বিজয়ী বীরই হউক না কেন মানুষের ক্ষমতারও যে একটা সীমা আছে এ কথায় তিনি বিস্মৃত হইয়াছিলেন নিরবচ্ছিন্ন সামরিক সাফল্য সত্ত্বেও বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নেপোলিয়নের শারীরিক ও মানসিক শক্তি শিথিল হইয়া পড়ে এবং আত্মবিশ্বাস হারাইয়া ফেলেন।

নেপোলিয়নের অদূরদর্শিতা:

নেপোলিয়নের অদূরদর্শিতাও তাঁহার পতনের অন্যতম কারণ ছিল।পর্তুগাল অধিকার করিবার জন্য তিনি স্পেনের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিয়া স্পেনবাসীর অন্তরে বিক্ষোভের সৃষ্টি করিলেন।
তিনি নিজ ভ্রাতাকে স্পেনের নেপোলিয়নের অদূরদর্শিতা ন্যায়সঙ্গত অধিপতি বলিয়া ঘোষণা করিয়া স্পেনজাতির আশাআকাঙ্ক্ষার অবমাননা করিয়াছিলেন; ইহার ফলে স্পেনের জনসাধারণ জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হইয়া তাঁদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন আরম্ভ করিল।
এই আন্দোলনের পরিণতিস্বরূপ সংঘটিত হইল পেনিনসুলার যুদ্ধ, যাহা নেপোলিয়নের পতন ত্বরান্বিত করিল) স্পেনেই নেপোলিয়নের সামরিক গৌরবের সমাধি রচিত হইল।

ইংল্যান্ডের অপরাজেয় নৌ-শক্তি:

ইংল্যান্ডের অপরাজেয় নৌ-শক্তি নেপোলিয়নের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ। স্থলযুদ্ধে নেপোলিয়ন অজেয় হইলেও ইংল্যান্ডের নৌ-বাহিনীর প্রতিরোধের ফলে তাঁহার পক্ষে শেষ পর্যন্ত সাফল্য লাভ করা সম্ভব হয় নাই।
ইংল্যান্ডকে হীনবল করার জন্য নেপোলিয়ন যে প্রাচ্য-পরিকল্পনা (Eastern Project) গ্রহণ করিয়াছিলেন নীলনদের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে তাহা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইল।
অতঃপর ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করিয়া সরাসরি ইংল্যান্ড আক্রমণ করার যে পরিকল্পনা তিনি গ্রহণ করিয়াছিলেন ট্রাফালগারের নৌ-যুদ্ধে (Battle of Trafalgar) পরাজয়ের ফলে তাহাও সফল হয় নাই।

কন্টিনেন্টাল সিস্টেমের ব্যর্থতা

অতঃপর, নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডকে হীনবল করিবার জন্য কন্টিনেন্টাল সিস্টেম (Continental System) নামে যে অর্থনৈতিক অবরোধ পরিকল্পনা গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহাও ইংল্যান্ডের নৌ-শক্তির প্রতিরোধের ফলে ব্যর্থ হইল) সুতরাং ইংল্যান্ডের অজেয় নৌ-শক্তিই নেপোলিয়নের সমস্ত পরিকল্পনা ব্যর্থ করিয়া তাঁহার পতনের কারণ ঘটাইল।

রাশিয়া অভিযানের ব্যর্থতাও

নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযানের ব্যর্থতাও তাঁহার পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। ১৮০৭ খ্রীষ্টাব্দে স্বাক্ষরিত টিলসিটের সন্ধির পর হইতে রুশ-ফরাসী সম্পর্ক ক্রমেই তিক্ত হইয়া উঠিতেছিল। রাশিয়ার জনসাধারণ জার আলেকজান্ডার রাশিয়া অভিযানের ব্যর্থতা নেপোলিয়নের প্রীতিপূর্ণ সম্পর্কের বিরোধী ছিল। তাহারা জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হইয়া ফ্রান্সের সহিত রাশিয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য দাবি জানাইল।

ইহার ফলে রাশিয়ার সম্রাট ‘টিলসিটের সন্ধি’ অনুযায়ী কন্টিনেন্টাল সিস্টেম সফল করার জন্য নেপোলিয়নকে সাহায্য করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন, তাহা পালন করিতে শেষ পর্যন্ত পিছাইয়া গেলেন। রাশিয়ার এই ব্যবহারের সমুচিত শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে নেপোলিয়ন ১৮১২ খ্রীষ্টাব্দে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযান আরম্ভ করিলেন, কিন্তু এই অভিযানে নেপোলিয়নের সামরিক গৌরব ও শক্তি বিনষ্ট হইল। ,

স্পেন, রাশিয়া, প্রাশিয়া ও ইতালীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলন

স্পেন ও রাশিয়ার আদর্শ অনুসরণ করিয়া প্রাশিয়ায়ও স্বাধীনতা-সংগ্রাম আরম্ভ হইল (War of liberation)। জার্মানীর অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অকারণ হস্তক্ষেপের ফলে নেপোলিয়ন জার্মানীর জনসাধারণকেও বিদ্বিষ্ট করিয়া তুলিয়াছিল। ইহার ফলে প্রাশিয়াকে কেন্দ্র করিয়া জার্মান জাতীয়তাবাদী শক্তি নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ সৃষ্টি করিল।) লাইপজিপের যুদ্ধে জার্মানীর সামরিক বাহিনীর নিকট নেপোলিয়ন পরাজয় স্বীকার করিতে বাধ্য হইলেন।) ইতালিতেও নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে অনুরূপভাবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হইয়াছিল। নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে স্পেন, রাশিয়া, প্রাশিয়া ও ইতালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কথা স্মরণ করিয়া বলা যায় — It was national patriotism which crushed Napoleon.

পোপ ও ক্যাথলিক রাষ্ট্রসমূহের সহিত শত্রুতা:

পোপ ও ক্যাথলিক রাষ্ট্রসমূহের সহিত শত্রুতা নেপোলিয়নের পতনের অন্যতম কারণ। পোপকে বন্দী করিয়া তিনি রোমান ক্যাথলিক পোপ ও ক্যাথলিক রাষ্ট্রসমূহের রাষ্ট্রসমূহের শ্রদ্ধা হারাইয়াছিলেন।) তিনি যদি উদারনীতি অবলম্বন করিয়া রোমান ক্যাথলিক রাষ্ট্রসমূহের সমর্থন লাভ করিতে পারিতেন, তাহা হইলে এত শীঘ্র তাঁহার পতন হইত না।

নেপোলিয়নের পতনের অপর একটি কারণ হইল তিনি ক্রমশ ফরাসী জনগণের আত্মবিশ্বাস ও জনপ্রিয়তা হারাইয়া ফেলেন। ক্রমাগত যুদ্ধের ফলে ফরাসী জাতির মনে অবসাদ দেখা দেয়। ইহা ভিন্ন, যুদ্ধের চার্পে ফরাসী অর্থনীতির ভারসাম্য ক্ষুণ্ন হয় এবং জনগণের দুর্দশা বৃদ্ধি পায়।

পরিশেষে বলা যায়, নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের পতন ছিল একপ্রকার অনিবার্য, কারণ (সাম্রাজ্যের চরিত্র ছিল স্ববিরোধী ও অসংগতিপূর্ণ। সমগ্র ইওরোপে সাম্রাজ্যের জাল বিস্তার করিয়া তিনি বিভিন্ন ইওরোপীয় রাষ্ট্রগুলিতে ফরাসী আধিপত্য স্থাপন করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *