সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির কারণ Study Learn
প্রশ্ন ১। সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির কারণগুলি আলোচনা করো।
উত্তর : সমুদ্রের জলরাশি একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়মিতভাবে প্রবাহিত হয়। সমুদ্রজলের এই গতিকে সমুদ্রস্রোত বলে। সাধারণভাবে বলা যায় যে, নিম্নলিখিত কারণগুলির জন্য সমুদ্রস্রোতের উৎপত্তি হয়—
সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির কারণ গুলি হল:
সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির কারণ:
(১) উষ্ণতার তারতম্য ও পরিচলন :
উষ্ণমণ্ডলে অধিক উত্তাপে সমুদ্রের জলরাশি আয়তনে বৃদ্ধি পায় এবং তার ঘনত্ব কমে যায়। সেইজন্য উষ্ণমণ্ডল থেকে উষ্ণ ও লঘু জল বহিঃস্রোতরূপে সমুদ্রের উপরিভাগ দিয়ে শীতল মেরুপ্রদেশের দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। আবার উষ্ণমণ্ডলে জল বেশি পরিমাণে বাষ্পীভূত হয়। সেইজন্য সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরিভাগের সমতা হ্রাস পায়। সমুদ্রপৃষ্ঠে জলের সমতা রক্ষা করার জন্য মেরু অঞ্চল থেকে শীতল ও ভারী জল সমুদ্রের নিম্নাংশ দিয়ে অন্তঃস্রোত রূপে উষ্ণমণ্ডলের দিকে প্রবাহিত হয়ে থাকে।
সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির কারণ: (২) বায়ুপ্রবাহ :
সমুদ্রের ওপর দিয়ে নিয়মিতভাবে নিয়ত বায়ু প্রবাহিত হয়। নিয়ত বায়ুর ধাক্কায় সমুদ্রের জল একদিক থেকে অন্যদিকে প্রবাহিত হতে থাকে। নিয়ত বায়ুপ্রবাহের দিক অনুসারেই বেশিরভাগ সমুদ্রের স্রোত প্রবাহিত হয়। যেমন—নিরক্ষীয় অঞ্চলে উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ুর প্রভাবেই সমুদ্রস্রোতের পশ্চিমমুখী প্রবাহ ঘটে থাকে এবং উভয় গোলার্ধের মধ্য অক্ষাংশে পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবেই সমুদ্রস্রোতের পূর্বমুখী প্রবাহ লক্ষ করা যায়।
সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির কারণ: (৩)স্থলভাগের আকৃতিঃ
প্রবাহপথে মহাদেশের কোনো অংশে বা দ্বীপপুঞ্জে বাধা পেলে তদনুসারে সমুদ্রস্রোতের গতি পরিবর্তিত হয়। যেমন—ব্রাজিল স্রোত ও ক্যানারি স্রোত যথাক্রমে দক্ষিণ আমেরিকার সেন্ট রক অন্তরীপে ও পোর্তুগালের উপকূলে প্রতিহত হয়ে দিক পরিবর্তন করে।
সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির কারণ: (৪) পৃথিবীর আবর্তন :
পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূর্বে নিজ আবর্তনগতির জন্য অবিরাম ঘুরে চলেছে। পৃথিবীর আবর্তনগতির জন্য ফেরেল সূত্রানুসারে বায়ুপ্রবাহের মতো সমুদ্রস্রোতেরও গতিবিক্ষেপ ঘটে এবং সমুদ্রস্রোত সরাসরি উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত হতে পারে না। পৃথিবীর আবর্তনের জন্য সমুদ্রস্রোতের গতি উত্তর গোলার্ধে ডানদিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বামদিকে বেঁকে যায়।
সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির কারণ: (৫) সমুদ্রজলের লবণাক্ততার তারতম্যের জন্য ঘনত্বের তারতম্য :
সমুদ্রজলে লবণাক্ততার পরিমাণ সর্বত্র সমান নয়, কোথাও বেশি ; কোথাও কম। কম লবণাক্ত জলের ঘনত্ব কম থাকায় সমুদ্রের উপরিভাগ দিয়ে এই জল বহিঃস্রোত রূপে অধিক লবণাক্ত অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। জলের এই অভাব পূর্ণ করার জন্য অধিক লবণাক্ত ভারী জল সমুদ্রের নিম্নাংশ দিয়ে অন্তঃস্রোত রূপে কম লবণাক্ত অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। যেমন—কম লবণাক্ত আটলান্টিক মহাসাগরের জল ভূমধ্যসাগরের দিকে বহিঃস্রোতরূপে এবং অধিক লবণাক্ত ভূমধ্যসাগরের জল অন্তঃস্রোতরূপে আটলান্টিক মহাসাগরের দিকে প্রবাহিত হয়।
→ প্রশ্ন ২ । আটলান্টিক মহাসাগরের প্রধান স্রোতসমূহের বিবরণ দাও।
• উত্তর : আটলান্টিক মহাসাগর পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাসাগর। এই মহাসাগরের স্রোতগুলি নিয়ত বায়ুপ্রবাহ, স্থলভাগের আকৃতি ইত্যাদি দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। এই মহাসাগরের বিভিন্ন স্রোতগুলি হল—
(১)উষ্ণ উত্তর ও দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোত ঃ পৃথিবীর আবর্তনগতি ও নিয়ত বায়ুপ্রবাহের ফলে নিরক্ষরেখার উভয়দিকে দুটি উন্ন স্রোতের সৃষ্টি হয়। নিরক্ষরেখার উত্তরেরটিকে বলে উত্তর নিরক্ষীয় স্রোত এবং দক্ষিণেরটিকে বলে দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোত।
(২) নিরক্ষীয় প্রতিস্রোত ঃ উত্তর ও দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোতের মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে এই দুটি স্রোতের বিপরীতমুখে, অর্থাৎ পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে যে উষ্ণ স্রোত প্রবাহিত হয়, তাকে নিরক্ষীয় প্রতিস্রোত বলে।
দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের স্রোতসমূহ
(৩) শীতল কুমেরু স্রোত ঃ দক্ষিণ মেরু সাগর থেকে মেরুবায়ুর প্রভাবে শীতল মেরু স্রোতের সৃষ্টি হয়। এই স্রোত ৬০° দক্ষিণ অক্ষরেখা অতিক্রম করার পর প্রবল পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে সরাসরি পশ্চিম থেকে পূর্বে বেঁকে যায়। একে শীতল কুমেরু স্রোত বলে। এই স্রোত আবার দুভাগে বিভক্ত হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে প্রবেশ করে। যেমন—
(ক) শীতল বেঙ্গুয়েলা স্রোত : শীত কুমেরু স্রোত উত্তর-পূর্বদিকে প্রবাহিত হওয়ার সময় দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপে বাধা পেয়ে আফ্রিকার দক্ষিণ পশ্চিম উপকূল বরাবর উত্তরে প্রবাহিত হলে তাকে শীতল বেঙ্গুয়েলা স্রোত বলে।
(খ) শীতল ফকল্যান্ড স্রোত : শীতল কুমেরু স্রোতের একটি ছোটো শাখা দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল বরাবর কিছুদূর উত্তরে অগ্রসর হয়। একে শীতল ফকল্যান্ড স্রোত বলে।
(৪) উষ্ণ ব্রাজিল স্রোত ঃ উল্লিখিত শীতল বেঙ্গুয়েলা স্রোত উত্তরে এগিয়ে এসে দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোতের সঙ্গে মিশে যায়। এই দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোত দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ুর প্রভাবে পূর্ব থেকে পশ্চিমদিকে প্রবাহিত হবার সময় ব্রাজিলের সেন্টে রক অন্তরীপে বাধা পেয়ে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়। দক্ষিণের শাখাটি উষ্ণ ব্রাজিল স্রোত নামে ব্রাজিলের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল বরাবর দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে শীতল কুমেরু স্রোতের সঙ্গে মিশে যায়।
উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের স্রোতসমূহ :
(৫) উষ্ণ ক্যারিবিয়ান স্রোত : দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোতের অপর শাখাটি ব্রাজিলের উত্তর-পূর্ব উপকূল বরাবর প্রবাহিত হয়ে নিরক্ষরেখা অতিক্রম করে ক্যারিবিয়ান উপসাগরে পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের নিকট উত্তর নিরক্ষীয় স্রোতের সঙ্গে মিলিত হয়ে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়। পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত শাখাটি ক্যারিবিয়ান স্রোত নামে পরিচিত।
(৬) উষ্ণ বাহামা স্রোত ঃ অপর শাখাটি পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের উত্তর দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাহামা দ্বীপপুঞ্জের কাছে উষ্ণ বাহামা স্রোত নামে পরিচিত হয়েছে।
(৭) উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোত : ক্যারিবিয়ান স্রোত মেক্সিকো উপসাগরে বাহামা স্রোতের সঙ্গে মিলিত হয়। এই মিলিত স্রোত উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোত নামে পরিচিত হয়। এই স্রোত পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে উত্তর-পূর্বদিকে বেঁকে প্রবাহিত হয়।
উপসাগরীয় স্রোত উত্তর-পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে প্রবেশ করে এবং পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে উত্তর-পূর্বদিকে বেঁকে মধ্য আটলান্টিক তিনটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে—
(ক) উষ্ণ উত্তর আটলান্টিক স্রোত ঃ উপসাগরীয় স্রোতের প্রধান বা মাঝখানের শাখাটি উত্তর আটলান্টিক স্রোত নামে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ ও ইউরোপের উত্তর-পশ্চিম উপকূল বরাবর উত্তর-পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে নরওয়ে উপকূলে শেষ হয়েছে।
(খ) ইরমিঙ্গার স্রোত : উত্তরের বা বাঁদিকের শাখাটি প্রথমে আইসল্যান্ডের দক্ষিণ দিক দিয়ে এবং পরে গ্রিনল্যান্ডের পশ্চিম উপকূল দিয়ে ইরমিঙ্গার স্রোত নামে সুমেরু মহাসাগরের দিকে এগিয়ে যায়।
(গ) শীতল ক্যানারি স্রোত : দক্ষিণের বা ডানদিকের শাখাটি শীতল ক্যানারি স্রোত নামে ইউরোপের পর্তুগাল ও আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিম উপকূল বরাবর প্রায় অর্ধবৃত্তাকারে বেঁকে উত্তর ও নিরক্ষীয় স্রোতের সঙ্গে মিশে যায়। এই কারণে এই অঞ্চলে জলাবর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এই জলাবর্ত স্রোতহীন হওয়ায় এর ভেতর শৈবাল, আগাছা ও কিছু উদ্ভিদ জন্মায়। তাই একে শৈবাল সাগর বলে।
(৮) উষ্ণ গিনি স্রোত : আফ্রিকার পশ্চিমে গিনি উপকূল বরাবর ক্যানারি স্রোত থেকে একটি ছোটো স্রোত সৃষ্টি হয়। একে উষ্ণ গিনি স্রোত বলে।
(৯) শীতল ল্যাব্রাডর স্রোত : উত্তর মেরু সাগর থেকে কানাডার পূর্ব উপকূল বরাবর একটি শীতল স্রোত প্রবাহিত হয়। এই স্রোত প্রথমে শীতল সুমেরু স্রোত ও পরে শীতল ল্যাব্রাডর স্রোত নামে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে উপসাগরীয় স্রোতের নীচে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোত ও শীতল ল্যাব্রাডর স্রোত বিপরীতমুখে প্রবাহিত হবার ফলে এই অঞ্চলে হিমপ্রাচীর সৃষ্টি হয়েছে।
(১০) শীতল গ্রিনল্যান্ড স্রোত : উত্তরে সুমেরু সাগর থেকে গ্রিনল্যান্ডের পূর্ব উপকূল দিয়ে একটি শীতল স্রোত দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়। এটি শীতল গ্রিনল্যান্ড স্রোত নামে পরিচিত।